২০১০ সালে নেওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ১০ বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হবে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ ভাগ। এখন পর্যন্ত মাত্র চার ভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এমন বাস্তবতায় ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে রোডম্যাপ প্রস্তুত করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এমন লক্ষ্য অর্জন কখনোই সম্ভব হবে না। যদিও সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার আলোকে ইউএনডিপি এবং এডিবির সাহায্য নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরিরও সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটি বলছে, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে মারকাস সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 'প্রতিটি ক্লাইমেট ভালনারেবল কান্ট্রি ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ রিনিউয়েবল এনার্জিতে যাবে।' তাই বাংলাদেশকেও এ লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে মাত্র ১৫ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা আছে। তাদের হিসাবে দেশে বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যুৎহীন এলাকাগুলোতে জনগণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন শ্রেণির নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে রয়েছে- জলবিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, গোবর এবং পোলট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস, ধানের তুষ এবং ইক্ষুর ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্প প্রক্রিয়ার অব্যবহূত তাপ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন ইত্যাদি।
বিশ্নেষকরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি কমানো। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন গড়ে ৪ দশমিক ৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। অন্যদিকে বায়ুবিদ্যুতের জন্য সম্ভাবনা এখনও গবেষণাধীন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্ভব নয়। এ দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল উৎস সৌরশক্তি। পর্যাপ্ত ভূমি না থাকায় বড় আকারের সৌরবিদ্যুতের প্রকল্প বাস্তবায়ন এখানে দুরূহ। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মানসম্মত সূর্যের আলোর প্রাপ্যতা বাংলাদেশে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। ফলে চাহিদা অনুসারে বিদ্যুতের জোগান মিলবে না। আর ২০৫০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। যার পুরোটা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে মেটানো সম্ভব নয়। বিশ্বের যেসব জায়গায় বিদ্যুতের চাহিদার পুরোটুকু নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেখানেই সংকট দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছিল। বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বেড়ে গেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পারছে না। শতভাগ না হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে যথাযোগ্য উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ম তামিম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেছেন, সার্কুলার ইকোনমি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এ নিয়ে কৌশলগত নীতিমালা তৈরি করছে। অচিরেই তা পাওয়া যাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে স্রেডা কাজ করছে। তাদের একটি রোডম্যাপও রয়েছে। এটিকে রিভাইজড করা যেতে পারে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, আগামী দুই বছরের জন্য জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মারকাসে একটি সিদ্ধান্ত ছিল, প্রতিটি ক্লাইমেট ভালনারেবল কান্ট্রি ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ রিনিউয়েবল এনার্জিতে যাবে। এখন এ সংস্থার প্রধান হচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। নিশ্চয়ই তিনি যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাবেন, বিশেষ করে ইউকেতে আগামী কপ সম্মেলনে যাবেন, সেখানে চারটি ফোকাস থাকবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষয়ক্ষতি। তাপমাত্রার বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য দেশের যতসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে তাদের পুনর্বাসন এবং শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এসব বিষয়ে তিনি অন্যান্য দেশকে বলবেন। সাবের চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলবেন তার গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। তাই ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শ্রীলঙ্কা শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে ইউএনডিপি এবং এডিবির সঙ্গে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার আলোকে ইউএনডিপি এবং এডিবির সাহায্য নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
সাবের হোসেন আরও জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া তৈরি হচ্ছে। সেখানে সবুজ অর্থনীতি, ডিকার্বোনাইজেশন, সার্কুলার ইকোনমি, রিনিউয়েবল এনার্জির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া যেতে পারে। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী জলবায়ুর বিষয়গুলোর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বিষয়গুলো নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করে। এ বিষয়গুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, পরিবেশ উন্নয়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সবুজ অর্থনীতিসহ যেসব কার্যক্রম রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরও উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় একা এগুলো করতে পারবে না। সে কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসা দরকার।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমকালকে বলেন, বর্তমান প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদন সম্ভব নয়। তবে প্রযুক্তি দিন দিন উন্নত হচ্ছে। ২০৫০ সাল আসতে আসতে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে পারে। তখন হয়তো অন্য জায়গায় বিপুল সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। বাতাসসহ অন্যান্য শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাজে লাগানো যাবে। এ জন্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনছি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতে এটা আরও বাড়বে।
সম্পাদক | মোঃ আক্তারুজ্জামান মনির | নির্বাহী পরিচালক | মোছাঃ উম্মে কুলছুম আক্তার | সাধারন সম্পাদক | মোঃ জহুরুল ইসলাম | প্রধান উপদেষ্ঠা | মোঃ শাফিরুল ইসলাম | মোঃ আব্দুর রহমান | হেল্পলাইন | ০৯৬৩৮৯০০৯৯৯ | ০১৭৩৫২৫০০৮২ | ০১৭১১০১০৮৯৬ | ০১৭১৯৬৬৯৩৩৬ | ই-মেইল | ichamotinews@gmail.com |
প্রিন্টিং কার্যালয় | মিতালী প্রেস ,শাপলা সুপার মার্কেট ,বগুড়া-বাংলাদেশ।