বগুড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাসহ ২ জনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা এবং ৬ বছরে ৪ জন খুন হয়েছে।
মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) বগুড়ায় আধিপত্য বিস্তার ও দীর্ঘদিনের বিরোধের ইতিটানতে সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মিজানুর রহমান মিজান (৩৮) কে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় নিহত মিজানের অনুসারীরা সানোয়ার হোসেন লেদো (৪২) নামে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। নিহত লেদো গোকুল ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য ও গোকুল উত্তরপাড়া গ্রামের বুলু মিয়ার পুত্র। নিহত ২ জনেই বগুড়া সদরের গোকুলের বাসিন্দা। ঘটনাটি ঘটে সোমবার রাত আনুমানিক ৮টায় গোকুল বন্দর এলাকায়।
ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসী ও নিহত মিজানের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গোকুল ইউনিয়ন যুবদলের সদ্য বহিস্কৃত সভাপতি বিপুলের সাথে দীর্ঘ দিন যাবত মিজানুরের বিবাদমান সংঘর্ষ হয়ে আসছিল। তাদের দাবী বিপুল বাহিনী এ হামলা চালিয়েছে মিজানকে হত্যা করেছে।
নিহত মিজান গোকুল পলাশবাড়ী গ্রামের আফসার আলী সাকিদারের পুত্র।
জানা যায়, গতকাল রাত ৮টার দিকে মিজান গোকুল বন্দরে আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহন লেবার শ্রমিক অফিসে বসে তার কর্মীদের সাথে সংগঠন বিষয়ক আলাপ করছিলেন। এ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ১০/১২ জনের একটি দুর্বৃত্তের দল দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে অফিসে ঢুকে মিজানকে এলোপাতাড়ি ভাবে কুপিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। মিজান কে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে মিজানকে কুপিয়ে জখম করে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মিজান গ্রুপের লোকজন সানোয়ার হোসেন লেদো কে মারপিট করে আহত করেন। তাৎক্ষণিক সংবাদ পেয়ে যৌথবাহিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহত লেদো মিয়াকে উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠায়।
এসময় মিজান নিহতের সংবাদ তার নেতাকর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে মিজান বাহিনী লোকজন জিয়া মেডিকেল চত্বরে গিয়ে আরেক দফায় লেদোকে পিটিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে। চলতি বছরের গত ৬ মে মিজানুর রহমান মিজান বগুড়া শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা যোগে মহাস্থান আসার পথে তাকে বহনকৃত সিএনজির পিছন থেকে ধারালো অস্ত্রের কোপ বসানো হয়। এসময় মিজানুরের সিএনজিটি দ্রুত মহাস্থান গ্রামে ঢুকলে এ যাত্রায় প্রাণে রক্ষা প্রায় মিজানুর। এ হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভাবে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিপুলের নাম উঠে আসে।
উল্লেখ্য, বগুড়া সদরের গোকুল “হল” বন্দর নামটি শুনলেই মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে।
জানা যায়, বগুড়া সদরের গোকুল ইউনিয়নের পলাশবাড়ী গ্রামের মিজানুর রহমান মিজান ও সুমন আহম্মেদ বিপুলের দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল।
শুধু নিজেদের অভ্যন্তরীণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ এলাকায় দু’গ্রুপের ২ জন খুনের ঘটনাও এর আগে ঘটেছে। তারপরও থেকে ছিল না নিজেদের আক্রোশ ও একে অপরের প্রতি হামলা। গত ২০১৮ সালে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তৎকালীন গোকুল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নিহত মিজানুর রহমানের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক বিপুলের বিরোধ চলছিল। ২০১৮ সালে ২৩ ফ্রেরুয়ারি ২-৩ দিন আগে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এর জের ধরে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিপুলের পক্ষের লোকজন সভাপতি মিজানুর রহমান পক্ষের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মিজানুর গ্রুপের মিজানুর, তার স্ত্রী নিশা, আব্দুল হাকিম ও কর্মী গোকুল মধ্যপাড়ার জামাত আলীর ছেলে সনি আহত হন। পরে তাদের উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করলে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সনি মারা যান।
এর জের ধরে গত ২০২০ সালে সুমন আহম্মেদ বিপুল গ্রুপের সক্রিয় আপেল মাহমুদ (৩৫) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। সে সময় নিহত আপেলের সঙ্গে থাকা তার বড় ভাই আল মামুন(৩৮)কে দুই হাতের আঙুল কেটে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টাও করা হয়। নিহত আপেল গোকুল ইউনিয়নের পলাশবাড়ী গ্রামের মৃত মান্নান কসাইয়ের পুত্র। ঘটনাটি ঘটে বগুড়া সদরের মহাস্থানের অদূরে চন্ডিহারা খোলাগাছির মোড়ের পাশে একটি লিচু বাগানে। নিহতের স্বজনদের দাবি, তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী সনি হত্যার জেরে ছাগল বিক্রির নামে দুই ভাইকে ডেকে এনে এ হামলা চালান মিজানুর রহমান মিজান।
নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দু’গ্রুপের ২টি তরতাজা প্রাণ গেলেও থেমে ছিল না তাদের বিবাদমান সংঘর্ষ। গত ৫/৬ মাস আগেও গোকুল ইউনিয়নের পলাশবাড়ী কসাইপাড়া গ্রামে সুমন আহম্মেদ বিপুলের ওপর হামলা চালাতে ওই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য বিপুল গ্রুপের ফাহিনুর ইসলামের বাড়ীতে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অর্কিত হামলা চালানো হয়। এসময় বিপুলকে না পেয়ে ফাহিনুরের বাবা আব্দুল মান্নানের পায়ে রাম দা দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। এখানেও উঠে আসে মিজানুর রহমান মিজানের নাম। মিজানুর রহমান মিজান ও সুমন আহম্মেদ বিপুল এক সময় তারা দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কিন্তু তাদের শত্রুতার সূচনা কোথা থেকে তা কিন্তু নিশ্চিত করা যায়নি।
তবে তামিল সিনেমার মত তারা একে ওপরের প্রতি ঘায়েল করতে সবসময় প্রতিযোতার তীর তাক করে থাকতো। তবে এবার মিজানুর চিরতরে প্রতিপক্ষের বলি হলেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আবু হাসান জানান, মিজানুর রহমান তার সংগঠনের প্রাণ ছিলেন। তার সাথে বহিস্কৃত যুবদল সভাপতি বিপুলের বিরোধ চলে আসার বিষয়টি সকলে জানেন। ওই বিরোধের জের ধরেই মিজানকে হত্যা করা হয়েছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুর রশিদ বলেন, হত্যাকান্ডের তদন্তের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা কাজ শুরু করেছেন। হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
মিজানুর রহমান মিজানের মৃত্যুর খবর শুনে তাৎক্ষণিক বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান, বগুড়া জেলা বিএনপি’র সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার হেনা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি মোশারফ হোসেন ও স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, ছাত্রদলসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
Leave a Reply