বগুড়ায় মোটা চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে তিন থেকে চার টাকা। ত্রাণ বিতরণে পণ্যটির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ক্রেতারা বলছেন, মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী বাজারে সিন্ডিকেট করতে চালের মজুদ করেছেন। তারাই এখন চালের কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছেন। আর একারণে প্রতিদিনই বাড়ছে চালের দাম।
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) বগুড়া শহরের রাজাবাজার, ফতেহ্ আলী বাজার ও শেরপুর উপজেলার স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে দেখা গেছে, মোটা মানের স্বর্ণা, রঞ্জিত ও হাইব্রিড চাল ৫৮-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। যা গত এক সপ্তাহ আগে ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারী মানের বিআর-২৮ ও ২৯ চালের কেজিতে বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত। বিআর ২৮ জাতের চাল আগে ৫৭-৫৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা দাম বেড়ে ৬০ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গত দুই সপ্তাহ আগেও ৫০ কেজির বস্তা কাটারিভোগ চালের দাম ছিলো ৩০০০ হাজার টাকা। এখন তা ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশিতে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ চালের দাম বাড়ার পেছনে অসাধু মিল মালিক ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দায়ী। শেরপুরের পাইকারি ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, সদ্য বোরো মৌসুম শেষ হয়েছে। তাই ধান-চালের সংকট নেই। বন্যা ও ত্রাণের অজুহাতে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ অটোরাইস মিল মালিকরা উত্তরাঞ্চলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে অটোরাইস মিলের সংখ্যা এখন পাঁচ শতাধিক। এছাড়াও সেমি অটো হাস্কিং মিলের সংখ্যা কমবেশি ৪০ হাজার। এসব মিলের উৎপাদিত চালের একটা অংশ অগ্রিম পেমেন্টে কিনে নেয় ২-৩টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে চালের বাজার স্বাভাবিক সরবরাহের কমবেশির ওপর মূল্য নির্ধারণ হয় না। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা।
উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রতিবছর আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয় সোয়া ১ কোটি মেট্রিক টন চাল। এই অঞ্চলের চাহিদার মিটিয়েও আরও প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তুু এই উদ্বৃত্ত ধান কোথায় কীভাবে বিক্রি হয় সেই তথ্য মিলাররা কখনো প্রকাশ করেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সোয়া ২ কোটি মেট্রিক টন চালের চাহিদার বিপরীতে যে পরিমাণে ধান উৎপাদন হয়, তাতে অল্প পরিমাণ চাল ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতিকে পুঁজি করেই সিন্ডিকেট সদস্যরা চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করেন কোনো ইস্যু পেলেই। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চালের মোকাম শেরপুর উপজেলা। এখানে আটটি অটোমেটিক রাইস মিল ও বেশ কয়েকজন আড়তদার রয়েছেন। তাদের গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রয়েছে কিন্তু তারা বিক্রি করছেন না। আবার বিক্রি করলেও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে চাল সরবরাহ করছেন। এছাড়া বড় বড় করপোরেট কোম্পানির গুদামগুলোতেও পর্যাপ্ত চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর ও ঢাকায় বড় বড় ওয়্যারহাউজ রয়েছে। সেখানে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রয়েছে বলে একাধিক ব্যবসায়ী সূত্র জানিয়েছে।
শেরপুরে মজুদদার অটোমেটিক রাইসমিল, ওয়েস্টার্ন অটোমেটিক রাইসমিল, আলাল এগ্রো, শাকিল চাউল কল, সঞ্জয় সাহা, গৌর সাহা, প্রদীপ সাহা, বাছেদ চাল কল, মোখলেস এগ্রো, মির্জাপুর আলম চাউল ঘরসহ একাধিক ব্যবসায়ীর গোডাউনে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রয়েছে বলে জানা গেছে।
বগুড়া জেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহ মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, বাজারগুলোতে মোটা চালের সরবরাহ নেই বললেই চলে। সরবরাহ ঘাটতির কারণেই এই মানের চালের দাম বেড়েছে। আর মোটা চালের দাম বাড়ার কিছু প্রভাব পড়েছে মাঝারি চালের বাজারে। এই ধরনের চালের কেজিতেও দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে বেচাকেনা হচ্ছে। এছাড়া বন্যার কারণে ত্রাণের জন্য চালের চাহিদাও বেড়ে যাওয়া দাম বাড়ার একটি কারণ।
বগুড়া শহরের ফতেহ্ আলী বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, হঠাৎ চালের দাম বাড়ার পিছনে অসাধু মিল মালিক ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দায়ী। বন্যার্ত এলাকায় ত্রাণ হিসেবে মোটা চালের চাহিদা বাড়ার বিপরীতে এ অঞ্চলে সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে। আবার মোটা চালের ক্রেতারা বাজারে তাদের চাহিদামত চাল না পেয়ে মাঝারী মানের চালে ঝুঁকে পড়ায় এসব চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
জেলার চালকল মালিকরা বলছেন, হাইব্রিড অর্থাৎ মোটা চালের প্রতি কেজিতে এক টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। দেশের চলমান বন্যার কারণে চালের বাজারে সাময়িক এই প্রভাব পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চালের দাম কমে আসবে।
Leave a Reply