আমার জানালা দিয়ে অঞ্জন দত্তের গানের মতো একটুখানি আকাশ দেখা যায় না। দেখা যায় পাশের বাড়ির বারান্দা। আপনাদের স্বস্থির জন্য বলছি, আমার জানালা আর পাশের বাসার বারান্দার জাগতিক জ্ঞান খুবই ভালো। তারা সবসময় তাদের মধ্যে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু যে বাড়ির অংশ তারা, সেই বাড়ির সদস্যদের জাগতিক জ্ঞান নিয়ে আমার এবং তাদের দুজনেরই অনেক সন্দেহ আছে।
তো পাশের বাড়ির বারান্দার গল্পে ফেরত আসি। এখন অনুমান করুন তো বারান্দাটা দেখতে কেমন? সবুজ গাছ, ছোট্ট চায়ের টেবিল আর চেয়ার কল্পনায় আসছে। যদি তাই হয়, তাহলে চোখটা কচলে একটু ভালোভাবে দেখুন, বারান্দায় ঝুলানো আছে একটা পর্দা। বারান্দায় পর্দা! বিষয়টা কেমন জানি একটু বেমানান। এই শহুরে বক্সগুলোর বারান্দায় হওয়ার কথা কথা ছিল একমাত্র খোলা হাওয়া ঢুকবার পথ কিংবা আকাশ দেখার ব্যর্থ চেষ্টার জায়গা। কিন্তু এর মধ্যে পর্দা এল কোথা থেকে!
এবার তাহলে আসি পর্দার পেছনের গল্পে। এই পর্দার পেছনে বারান্দায় আছে মোটামুটি অব্যবহারযোগ্য একটা শৌচাগার আর একটা বাসন মাজার কল। এখন নিশ্চয় চিত্রটা অনেকটা পরিষ্কার যে, এটি বাড়ির সব থেকে অবহেলিত বারান্দা। রান্না ঘরের সঙ্গে কিংবা গৃহকর্মীর ঘরের সঙ্গের বারান্দা, যেই বারান্দায় সবুজের স্থান হয় না, স্থান হয় স্যাঁতস্যাঁতে ঘর মোছার ন্যাকড়ার। আর এই পর্দার আড়ালে বাস করে দুই পায়া কিছু জন্তু। কী, জন্তু বলায় অনুভূতিতে আঘাত লাগল নাকি? যদি লেগে থাকে তাহলে আগে থাকতেই বলে নিচ্ছি, এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। তার সঙ্গে এও বলছি, প্রাণিরা এই দুপায়া অদ্ভূত জন্তুকে নিজেদের দলে নিতে লজ্জা পায়। কেন লজ্জা পায়, কারণ এই দুপায়া অদ্ভূত জন্তু তাদের বাসায় থাকা সব থেকে অসহায় মানুষটার ওপর নির্যাতন করে।
নির্যাতন শব্দটা যদি অপরিচিত লাগে, তাহলে বলি নির্যাতন মানে হলো হিংসাত্মক আচরণ, তা শারীরিক বা মানসিক যাই হোক না কেন। যেমন, খাবারের খোঁটা দেওয়া, গালি দেওয়া, গায়ে গরম পানি ছিটিয়ে দেওয়া, আরও অনেক কিছু যা লিখতে গেলে আমার কলমের কালি, খাতার পাতা, আপনাদের ধৈর্য সবই ফুরিয়ে যাবে। এই তো গেল বারান্দার গল্প। এবার আসি জানালার কাছে। জানালার শিকের ভিতরেও কিছু দুপায়া জন্তু বাস করে। যারা কি না একই সঙ্গে অন্ধ, বোবা ও কালা। কারণ তারা তাদের জানালা দিয়ে কিছু দেখতে পায় না বা শুনতে পেত না বারান্দায় পর্দা লাগার আগে থেকেই।
কিন্তু জানালার পাশে বসে বসে পরীক্ষায় পাশের জন্য মোটা মোটা আইনের বই পড়ত। মাঝে মাঝে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মানবধিকার নিয়ে গল্প করত তার বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু কেন জানি পাশের বাসার বারান্দার চিৎকার তাকে ছুঁতে পারত না। কোন এক মঙ্গল কিংবা অমঙ্গলের সন্ধ্যায় এক-দুপায়া জন্তু গিয়ে দাঁড়াল জানালার পাশে। দেখল একটা অসহায় চেহারা এবং অসহায় চেহারার দিকে ছুটে আসা একটা চীনা মাটির থালা, অশ্রাব্য গালি এবং তারই সঙ্গে কিঞ্চিৎ প্রহার। কিঞ্চিৎ প্রহারের অর্থ বুঝছেন না এই একটু চড় থাপ্পড় আরকি। এগুলো তো আমাদের জীবনের অংশ বিশেষ, এ নিয়ে এত লাফালাফি করার কি আছে!
কিন্তু এই কম বুদ্ধি সম্পন্ন দুপায়া জন্তুর হঠাৎ কেন জানি একটু লাফালাফি করতে মন চাইল। সে এক বিশেষ নম্বরে ফোন দিল সাহায্যের জন্য। তারা তাকে বলল, আপনি যাবেন আমাদের সঙ্গে ওই বাড়িতে? সে বলল, হ্যাঁ। বিশেষ নম্বর থেকে বিশেষ সহযোগিতা এল। কিন্তু তারা এই কম বুদ্ধি সম্পন্ন দুপায়া জন্তুকে তাদের সঙ্গী করল না। তারপর এক ঘণ্টা যায়, দুই ঘণ্টা যায়-কোনো খবর আসে না।
অতঃপর বুদ্ধিহীন এই দুপায়া জন্তু খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে কি হয়েছিল আর এখন কি হবে জানতে। মুঠোফোনের ওপার থেকে শুধু দুটো শব্দ ভেসে এল, ‘বিষয়টা পারিবারিক।’ অতঃপর বারান্দায় পর্দা ঝুলল পারিবারিক বিষয়কে বোধ-বুদ্ধিহীন অবিবেচক দুপায়া জন্তুর কাছ থেকে আড়াল করার জন্য। তবুও কেন জানি সেই অবিবেচক বুদ্ধিহীন দুপায়া জন্তু মাঝে মাঝেই জানালার পাশে দাঁড়ালেই কেন জানি একটা চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। কিন্তু কী আর করার, ‘বিষয়টা যে পারিবারিক’।
Leave a Reply