আসসালামু আলাইকুম। আমি ওয়াজিদা শহীদ। ছোটবেলায় ভাবা হয় একরকম আর জীবনে ঘটে অন্যরকম। আসলে ছোটবেলায় কেউ আগে থেকেই বলতে পারে না সামনে তার জীবনে কি কি ঘটবে।
আমাদের সমাজে মেয়েরা আজও অবহেলিত নির্যাতিত। প্রতিটা পদেপদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমায়। ২০০৭ সালে পরিবার থেকে আমার পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। ইচ্ছা না থাকলেও মেনে নেয়ার চেষ্টা করে সংসার শুরু করতে হয়। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশুনা করে নিজে কিছু একটা করব। কিন্তু সে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন থেকেই আবার পড়াশুনা শুরু করার জন্য নানা ভাবে পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করি। ২০০৮ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হই। কিন্তু পড়াশুনা শুরু করতে না করতেই প্রথম সন্তানের জন্ম হয় ২০০৯ সালে আবার পরিবার থেকে পড়াশুনায় বাধার সৃষ্টি করা হয়। বন্ধ হয়ে যায়। মনটা ভেঙ্গে যায় আমার, কিন্তু মনে মনে ঠিকই ঠিক করে রাখি যত দেরিই হোক না কেন আবার শুরু করব পড়াশুনা। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। যাই হোক এরপর ঠিক করলাম নিজে কিছু একটা শুরু করতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। বড় বোনের কাছে থেকে ব্লকের কাজ শিখে নিলাম আর তারপর ২০১০ সালে ঘরে বসেই ব্লক ও হাতের কাজের ড্রেস, কার্টওয়াক এর চাদর ও কুশোন কাভার নিয়ে শ্রীমঙ্গলে ব্যবসা শুরু করি। খুব অল্প দিনের মাঝেই ব্যবসাটাকে দাড় করতে পারি। হাজার বাধাকে উপেক্ষা করে। আমার কাজ আর সংসার নিয়ে ভালোই চলছিল। ২০১৪ সালে জীবনে আরও একটা ঝড় নেমে আসে আর সেই অশান্তির জীবন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার ত্যাগ করে বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হই। সংসার ছেড়ে আসার পর সংগ্রাম আরও বেড়ে যায়। বাবার বাড়ি চলে আসলেও, এখান থেকেই নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু সেখানেও বাধা বড় ভাই আমার ব্যবসা বন্ধ করার জন্য বাবাকে বললো আর বাবা আমার বন্ধ করে দিতে বললেন। তাই আমার ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হই ২০১৬ সালে। কিন্তু সংসার থেকে আসার পর নতুন করে পড়াশুনাটা শুরু করতে পারি। পরিবার থেকে তেমন সহযোগীতা পেতাম না। আমার এক কাজিন আমার ইন্টারমিডিয়েট এর পড়াশুনার খরচ দিত সেটা দিয়েই ইন্টার কমপ্লিট করি। এরপর বাবা অনার্স এ ভর্তি করে দিতে রাজি হয়। আমি বগুড়ার পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ তে ভর্তি হই। কারণ বাবাই খরচ চালাবে বলে। ২০২০ সালে করোনার মাঝে সব অনলাইন ভিত্তিক হওয়ার ফলে অনলাইনেই ক্লাস পরীক্ষা চলছিল। এমন সময় পরিবার থেকে আবার পড়াশুনা বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়। আমি সেটা মেনে নিতে পারি না। বাবাকে জানিয়ে দেই আমি পড়াশুনা বন্ধ করব না। আমি নিজেরটা নিজেই ব্যবস্থা করব। এরপর আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করি। অনলাইনে কি করে ব্যবসা করতে হয় কিছুই জানা ছিল না আমার। সেপ্টেম্বর মাসে ১৩ তারিখে আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে উই এর কথা জানতে পারি ঐ দিন রাতেই আমি উই এ জয়েন করি। তারপর থেকে নিয়মিত এক্টিভ থেকে শেখার চেষ্টা করি বোঝার চেষ্টা করি। অক্টোবর এর ১ তারিখে পেজ খুলে উই এর হাত ধরে নতুন করে পথ চলতে শুরু করি। উই আমাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি দিয়েছে। আমি সকলের সকল বাধাকে অতিক্রম করে উই এর মাধ্যমে নিজের পরিচয় তৈরি করতে পেরেছি। এই কয়েকটা বছর আমাকে কি কি সহ্য করতে হয়েছে তা ভাষায় বলে শেষ করা সম্ভব নয়। আমি চেয়েছিলাম নিজের মতো করে বাঁচতে উই আমায় তা দিয়েছে। এতো সুন্দর একটা দেশি পণ্যের প্লাটফর্ম পেয়ে আমার মতো অসহায় অবহেলিত নারী জীবনটাকে বদলাতে পেরেছি। এখন নিজের খরচ বাচ্চাদের জন্যেও অনেকটা করতে পাচ্ছি উই এর কল্যাণে। আর সঙ্গে গ্রামের কিছু অসহায় নারীর কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করতে পেরেছি। এখন আমার কাছে গ্রামের অনেক মেয়েরাই কাজের জন্য আসে। তাদের নিজের উদ্যোগে যুক্ত করতে পেরে ভীষণ ভালো লাগে। আল্লাহ সহায় হলে আমার উদ্যোগে আরও নারীকে যুক্ত করবো। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ। নিজের উদ্যোগ নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার আর সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। আমি উই পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। নতুন করে জীবন দেয়ার জন্য। উই আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। উই থেকে এই পর্যন্ত আমার অনেক প্রাপ্তি। উই ভালোবাসা ও ভরসার জায়গা। এখনো নানা বাধা অতিক্রম করে উই এর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। উই আমার মনের সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। আমি যেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে বেঁচে থাকতে পারি। দুইটা সন্তানকে নিয়ে যেন নিজের মতো করে চলতে পারি। সকলের দোয়া কামনা করছি। পরিবারের সহযোগীতা একটা সময় আমি পাইনি। তবে এখন অনেক সাপোর্ট পাই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে এইখানে দাঁড় করতে পেরেছি। আল্লাহ সহায় হলে আরও সামনে এগিয়ে যেতে চাই। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চাই আমি। আমি অসংখ্য ধন্যবাদ জানায় উই জননী নাসিমা আক্তার নিশা আপুকে আমাদের মতো নারীদের জীবন বদলানোর জন্য এতো সুন্দর একটা প্লাটফর্ম তৈরি করার জন্য।
আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন: www.fb.me/bd.ichamotinews
Leave a Reply