পেপ গার্দিওলার কথা তাহলে মিথ্যা নয়।
চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতের পর কথাটা বলেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি কোচ। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শেষ আট থেকে ম্যাচগুলো দুই লেগের বদলে এক লেগে নামিয়ে আনে উয়েফা। তখন অনেকেই হয়তো ‘জাত গেল, জাত গেল’ রব তুলেছিলেন। কিন্তু গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘এখন একদম বিশ্বকাপের মতো অবস্থা হবে। প্রতিটি ম্যাচই ফাইনাল। হয় থাকবেন, নয় তো চলে যেতে হবে।’ কাল রাতে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে গার্দিওলার দলকেই। হারের কষ্টটুকু আলাদা করলে গার্দিওলা এর থেকে ভালো চমক আর পেতে পারতেন না।
চমক? হ্যাঁ, এটাই চ্যাম্পিয়নস লিগের ‘নিউক্লিয়াস’। আর এক লেগের ম্যাচ হওয়ায় তা ফুটে বেরোচ্ছে। কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সেলোনা-বায়ার্ন মিউনিখ ম্যাচের কথাই ধরুন। দুই লেগের ম্যাচ হলে বেশ কিছু সমীকরণ মাথায় রাখতে হতো। প্রতিপক্ষের মাঠে গোল করা, নিজেদের মাঠে গোল হজম না করা এসব তো আছেই। খেলার ধারেও তার প্রভাব পড়ত। প্রথম লেগে প্রতিপক্ষের মাঠে প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর বাকি সময় তারা রক্ষণ সামলে খেললে দোষ দেওয়া যেত না। ফিরতি লেগ তো আছেই। একই কথা খাটে গোল হজম করা দলের ক্ষেত্রেও। অন্তত ফেরার সুযোগটা থাকে।
কিন্তু ম্যাচটা এক লেগের হওয়ায় মরিয়া ফুটবল খেলেছে দুই দলই। বার্সা হয়তো দাঁড়াতে পারেনি তবে লাভটা হয়েছে নিরপেক্ষ সমর্থকদের। ১০ গোলের ম্যাচ, যেখানে কোনো দল একাই করেছে ৮ গোল! দুই লেগের ম্যাচ হলে এমন মরিয়া খেলা দেখার সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে তো মজাও করেছেন, দুই লেগের সব গোল এক লেগেই দিল বায়ার্ন। কিংবা একটু অন্যভাবেও দেখা যায় অলিম্পিক লিওঁ-ম্যানচেস্টার সিটি ম্যাচের প্রসঙ্গ টেনে। দুই লেগের লড়াই হলে কোন দলের জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকত?
জবাবটা দিতে ফুটবল বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। এ সহজ হিসেব। দল যত শক্তিশালী, ম্যাচসংখ্যা যত বেশি তাদের জয়ের সম্ভাবনাও তত বেশি। দুই লেগের ম্যাচ অপেক্ষাকৃত ভালো দলই বেশি জিতে থাকে। কারণ তাদের শক্তির গভীরতা—যা দুই লেগেই কাজে লাগাতে পারে—অভিজ্ঞতা এবং নতুন আরেকটি সুযোগ পাওয়া। ধরুন প্রথম লেগে লিওঁ-র কাছে ২-০ ব্যবধানে হারল সিটি। ফিরতি লেগে এখান থেকে সিটির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা যত বেশি থাকবে একই ব্যবধানে পিছিয়ে লিওঁ-র ওঠার সম্ভাবনা কমবে। ঘটাতে হবে অলৌকিক কিছু। এক লেগের ম্যাচে এসব ফাঁকফোকর নেই। যা করার করতে হবে শেষ বাঁশি বাজার মধ্যে। তাই চমক আর উত্তেজনাও বেশি।
এবার কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচগুলোই দেখুন। লিসবনে পিএসজি ও আতালান্তা নামার পর কী ভেবেছিল দুই দল? আন্দাজে বলা যায়, পিএসজি ভেবেছে গত এক দশকের সেমিতে ওঠার সেরা সুযোগ এটাই। আর আতালান্তা? পিএসজির কৌলীন্যর ধারে-কাছেও না থাকা দলটির জন্য এটা ছিল নিজেদের ক্লাব ইতিহাসের সেরা সুযোগ। মাত্র ৯০ মিনিটের লড়াই, এ সময় মাঠে যে দল ভালো করবে তারাই জয়ী। কোনো ফিরতি লেগ না থাকায় পরের লেগের সমীকরণ নিয়ে ভাবার সুযোগ ছিল না। সোজা কথায় মরণ-কামড় দেওয়ার ম্যাচ। আতালান্তা এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত পেরে না উঠলেও খেলেছে মনে রাখার মতোই। দুই লেগের ম্যাচ হলে তাদের জালে গোলবন্যাও হতে পারত।
পিএসজি মানে বড় বড় দলগুলোর ক্ষেত্রেও এই এক লেগের ম্যাচ কিন্তু বেশ ইতিবাচক। ছোট দলগুলো ফিরতি লেগে নিজেদের মাঠে অনেক সময় ঘুরে দাঁড়ায়। সেই দুশ্চিন্তা ছিল না নেইমার-কিলিয়ান এমবাপ্পেদের। তাই ৯০ মিনিটের লড়াইয়ে নিজের সেরাটা দিয়েই খেলেছেন নেইমার। ফিরতি লেগ মাথায় রেখে চোট এড়িয়ে খেলার প্রবণতা ছিল না কারও মধ্যে। ভাবনার জায়গাটাও এখানেই। ফিরতি লেগের ম্যাচে খেলোয়াড়েরা প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন প্রথম লেগের ফল দেখে। এবার সে সুযোগ নেই। একবার ভেবে দেখুন, ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ক্লাব সিটিকে প্রথম লেগে ৩-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছে লিওঁ। ফিরতি লেগে অবশ্যই সিটির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা বেশি ছিল। ফিরতি লেগ না থাকায় ধাক্কাটা কিন্তু দেখা গেল।
একই কথা খাটে লাইপজিগ-অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ম্যাচেও। সাম্প্রতিক সময়ে লাইপজিগের উত্থান ঘটলেও ধারে ও ভারে অ্যাটলেটিকোই ফেবারিট ছিল। কিন্তু মাঠে দেখা গেল উল্টো। অ্যাটলেটিকোকেই বিদায় করে লাইপজিগ উঠল সেমিতে। অর্থাৎ দুই লেগের ম্যাচে বড় দল ও ছোট দলের মধ্যে সম্ভাবনার পার্থক্য অনেক কমে আসে। যে কারণে এবার শেষ আটে এত সব চমক দেখা গেল। আতালান্তা, লিওঁ, লাইপজিগের মতো ছোট দলগুলো জানত একটাই সুযোগ যেখানে নিজেদের সর্বস্ব নিংড়ে দিলে যে ফল মিলবে পরে তা কেউ ওলটাতে পারবে না।
খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। একটা ম্যাচ, যেখানে একটা মুহূর্ত ওই খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারের গতিপথ বেঁধে দিতে পারে। এ কারণে বিশ্বকাপে নকআউটপর্বের ম্যাচগুলোয় খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স সবাই চ্যাম্পিয়নস লিগের চেয়ে বেশি মনে রাখে। তা ছাড়া দুই লেগ মানে তো অনেক বেশি ম্যাচ, অনেক বেশি পরিশ্রম, ক্লান্তি ও চোটের ধকল। এত ঝামেলা থাকলে দুই লেগে পরিপূর্ণ মনোযোগ দেওয়াও কঠিন। তার চেয়ে একটা সুযোগই ভালো, দুই দলের সম্ভাবনার ব্যবধান যেমন কমে আসে তেমনি ভালো খেলোয়াড়দের মানটাও আরও ভালোভাবে নির্ধারিত হয়। ফিরতি কোনো সুযোগ নেই, যা করার ৯০ মিনিটের মধ্যেই করে দেখাও।
Leave a Reply